রাশিয়া যে কারণে চীনের সঙ্গে একত্র হয়েছে
সম্প্রতি রাশিয়া ও চীনের সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধবিমানের যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটা ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট খোলার চেষ্টার অংশ ছিল মহড়াটি। ইন্দো-প্যাসিফিক উপকূল, দক্ষিণ চীন সাগর ও জাপান সাগরের ওপরে বর্তমানে বৈশ্বিক মনোযোগ রয়েছে। প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছেও।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবন্ধকতা দূর করার নানা উদ্যোগের অন্যতম সঙ্গী জাপান। সেসব উদ্যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীনের বিরুদ্ধে পিআরএসএম ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। রাশিয়ার বিরুদ্ধেও এটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য রয়েছে। জাপানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং এফ-৩৫-এস বিমান রাশিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ। তবে জাপানকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না রাশিয়া। জাপানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন, চীনের সঙ্গে রাশিয়ার এ সামরিক মহড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে জাপানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীকে ঠেকানো। জাপানের বিরুদ্ধে এ মহড়া নয়।
মার্কিন আধিপত্যের বিপরীতে বৈশ্বিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় চীনের সঙ্গে মৈত্রীর পথ বেছে নেয় রাশিয়া। এ মৈত্রী অবশ্য নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে নয়। এই মৈত্রীর অর্থ হচ্ছে রাশিয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাদের চাপিয়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনকে দর-কষাকষির হাতিয়ার বা মাধ্যম করেছে।
একইভাবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতাও মস্কোর জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নয়াদিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে একগুচ্ছ কৌশলগত চুক্তি সই করেছে। এর ফলে মার্কিন সামরিক তথ্যভান্ডার থেকে তথ্য, ছবিসহ অন্যান্য বস্তুগত সমর্থন পাবে ভারত। এটা ভারতের সামরিক সামর্থ্য বাড়িয়ে দেবে। দীর্ঘদিনের মিত্র ভারত ওয়াশিংটনের সঙ্গে নতুন জোট বাঁধায় মস্কোর উদ্বেগ বাড়ছেই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াকে দুর্বল করা এবং নিজেদের প্রভাব বিস্তারের এমন কোনো সুযোগ নেই, যেটা গ্রহণ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোকে ন্যাটোর সদস্যপদ ও নানা আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে এবং ভূরাজনৈতিক চক্রান্ত করে রাশিয়ার জন্য একের পর এক সমস্যা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এত সব সুস্পষ্ট প্ররোচনা সত্ত্বেও রাশিয়ার বিদেশনীতি দীর্ঘদিন ধরেই প্রায়োগিক ও বাস্তবধর্মী। মার্কিন আধিপত্যের বিপরীতে বৈশ্বিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় চীনের সঙ্গে মৈত্রীর পথ বেছে নেয় রাশিয়া। এ মৈত্রী অবশ্য নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে নয়। এই মৈত্রীর অর্থ হচ্ছে রাশিয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাদের চাপিয়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনকে দর-কষাকষির হাতিয়ার বা মাধ্যম করেছে।
রাশিয়ার সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজ কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কায় যায়। এটিও মস্কোর একটি কৌশলগত সংকেত। এর মাধ্যমে ভারতকে আশ্বস্ত করা আর আঞ্চলিক সব শক্তিকে এই বার্তা দেওয়া যে তাদের প্রয়োজনে রাশিয়া তার নৌবহর নিয়ে হাজির হয়ে যাবে।
রাশিয়া সম্প্রতি স্যাটেলাইট-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এতে মহাশূন্যে ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্যাটেলাইটটির ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে পড়ে। এসব ধ্বংসস্তূপ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র ও চীনের মহাকাশ কেন্দ্রের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এ ঘটনায় বিশ্বের অনেক দেশসহ নানা জায়গা থেকে নিন্দা উঠেছে। কিন্তু চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ঘটনায় নীরব রয়েছে। এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে রাশিয়ার সঙ্গে মহাকাশে যৌথভাবে কাজ করতে চীনের আগ্রহ রয়েছে। রাশিয়া ও চীনের এ আঁতাত দুই পক্ষকেই শক্তিশালী করবে। কিন্তু এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক চন্দ্র গবেষণা কেন্দ্রের (আইএলআরএস) প্রসঙ্গ তোলা যায়। গবেষণার জন্য চন্দ্রপৃষ্ঠে কিংবা চাঁদের কক্ষপথে অথবা উভয় স্থানেই কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। হাইটেক এই প্রকল্পের খুব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
আইএলআরএস প্রকল্পটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আর্টিমিস প্রকল্পটিকে টেক্কা দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে চাঁদের ওই গবেষণাকেন্দ্রে গিয়ে বিজ্ঞানীরা যাতে সরাসরি গবেষণায় অংশ নিতে পারেন। চীনের সঙ্গে যৌথ চন্দ্র গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়ার আগে রাশিয়ার প্রকল্পে অবশ্য মানুষকে নিয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনা ছিল না। চীনের সঙ্গে যৌথভাবে ঘোষিত রাশিয়ার আইএলআরএস প্রকল্পে অন্য দেশের জন্য দরজা খোলা রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্টিমিস প্রকল্পে সহযোগী দেশগুলোর জন্য একটি আইনগত রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু আইএলআরএস প্রকল্পে সেটা দৃশ্যমান নয়।
আর্টিমিস প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো কিছু নীতিমালা ঠিক করেছে। এ বছরে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ সম্মেলন। আইএলআরএস প্রকল্প নিয়ে রাশিয়া ও চীন সেখানে খোলাসা করবে অনেকে আশা প্রকাশ করলেও তাদের হতাশ হতে হয়েছে।
সবশেষে বলতে হয়, রাশিয়ার কূটনৈতিক সংযম এবং দেশ বেছে বেছে মৈত্রী স্থাপনের ঘটনা তত দিন পর্যন্ত থাকবে, যত দিন জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত তাদের আচরণ বদল না করে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত